মুহাম্মদ নাঈম: অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ সংগঠন ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বুধবার (২৩ অক্টোবর)। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’–এর ক্ষমতাবলে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। একই সাথে এই আইন তফসিল-২ অনুযায়ী ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামের ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কুকর্মগুলো বাংলাদেশের সময় ডটকমের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-

সহিংসতা: ১৯৯০-এর দশক পরবর্তী সময়ে সংগঠনটি তাদের বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। গত ১৬ বছর এমন কোনও অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। দেশের প্রতিটি সহিংসতার পিছনে এই নিষিদ্ধ সংগঠন দায়ী। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি শিশু-নারীরাও।

জঙ্গি সংগঠনে জড়িত: ২০১৬ সালের জুলাইয়ে গুলশান হামলার পর জঙ্গি তল্লাশিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাথেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

নারীদের দিয়ে পতিতাবৃত্তি: ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ইডেন মহিলা কলেজ শাখার ছাত্রীদের ব্ল্যাকমেইল করে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি চক্র চালানোর অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি কলেজের নারীনেত্রীদেরকে দিয়ে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের মনরচ্ঞন করতে বাধ্য করতেন ছাত্রলীগ। এনিয়ে দলটি বেশ কয়েকজন নেত্রী গণমাধ্যমে অভিযোগও করেন।

ধর্ষণ ও লুন্ঠন: সংগঠনটি প্রায়সময় ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, খুন, লুটপাট, যৌন সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা দুর্ধর্ষ ক্যাডার জসিমউদ্দিন মানিক ১০০ ছাত্রীকে ধর্ষণের ‘সেঞ্চুরি উৎসব’ পালন করেছিল।

আবু বকর হত্যাকাণ্ড: আবু বকর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে একদিন পর মারা যান

জুবায়ের হত্যাকাণ্ড: জুবায়ের আহমেদ ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। ২০১২ সালের ৮ই জানুয়ারি ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্কলহে বিরোধীপক্ষের হামলায় আহত হয়ে একদিন পর মারা যান। এই ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড এবং দু’জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড: ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ধংসাত্মক এবং আইনবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে এই ছাত্র সংগঠনটি দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় যখন এই সংগঠনের কিছু সদস্য বিশ্বজিৎ নামের একজন দর্জি দোকানীকে হরতাল চলাকালে ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাতের সময় কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। বিশ্বজিৎ সে সময় হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যুবরণ করে।

পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘটনায় জড়িত কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে মামলা করা হয়। বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ জন কর্মীর মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। বাকি ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেয় আদালত।

এহসান রফিক নির্যাতন: ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দ্বারা নির্যাতিত হোন। এতে তার চোখের কর্ণিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলন: ২০১৩-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন, ২০১৮-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ২০২৪-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিছিল করে এবং আন্দোলকারীদের উপর রড, লাঠি, হকি স্টিক, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। ১৫ জুলাই, ২০২৪ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে নারীদের উপর সহিংসতার অভিযোগও রয়েছে।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন: ২০১৮-র নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও অবরোধ করতে চাইলেও দুর্ঘটনার পরদিন থেকেই পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে; পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও তৎকালীন আওয়ামী সরকার-সমর্থক যুবকেরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রছাত্রী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে। এদিকে ২, ৪, ৫ ও ৬ তারিখ ছাত্রলীগসহ তৎকালীন আওয়ামী সরকার-সমর্থক যুবকেরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সংবাদ-সংগ্রহে-যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করে; সেসব সংঘর্ষে প্রায় দেড় শতাধিক জন আহত হন; পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের প্রতি নির্বিকার থাকলেও বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের দমাতে লাঠিচার্জ, কাঁদানেগ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। প্রায় ১১৫ জন শিক্ষার্থী ও ১৫ জন সাংবাদিক আহত হন।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড: বুয়েট তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথে তার জড়িত থাকা নিয়ে সন্দেহ করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্দেহ করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের ২২ বছর বয়সী ছাত্রকে তার সাম্প্রতিক একটি ফেসবুক পোস্টের কারণে আক্রমণ করা হয়েছিল, যা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির সমালোচনা বলে মনে হয়েছিল।

গৃহবধু ধর্ষণ: ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের শাহ পরাণের মাজার ভ্রমণ করে ফেরার পথে মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্রাবাসে এক গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হয়। স্বামীর কাছ থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের এই ঘটনায় ৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়, যাদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ঘটনার পর পলাতক আসামিদের কয়েকজনকে দ্রুত গ্রেফতারে সক্ষম হয় পুলিশ। ধর্ষণের এই ঘটনায় ছাত্রলীগের ভূমিকা নিয়ে সারাদেশে সমালোচনা হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, “ধর্ষণ তো দূরের কথা, কেউ নারীর প্রতি বিন্দুমাত্র আড়চোখে তাকানোর সাহস করে, এমন কোনো কর্মী বাংলাদেশ ছাত্রলীগে নেই।”

ঢামেকে শিক্ষার্থী নির্যাতন: ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলে ইন্টার্ন চিকিৎসক এএসএম আলী ইমাম শীতলকে তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাসহ হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে দেয়। মাথায় আঘাতের ফলে বমি শুরু হলে তাকে বের করে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে কলেজ ছাত্রলীগ এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতারা জড়িত। শীতল ঢামেক ছাত্রলীগের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক।

ছাত্রলীগের হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত বিরুদ্ধে নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সহিংসতা, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত এবং ১,৫০০ জন গুরুতর আহত হয়েছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ১২৯ জনে, শুধু ২০১৮ সালেই ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।