বাংলাদেশ সেনাবাহিনী: বর্তমান শতকে বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সার্বিক বিস্তারের সূচনা হয়েছিল এক এগারো সরকারের আমলে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশের শাসনকালে মোটামুটি একপাক্ষিক (Unipolar) বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশে বিএনপির নেতৃত্বে তৎকালিন চারদলীয় সরকার খানিকটা ইসলামপন্থী ও স্বাধীনচেতা হওয়ার ফলে ওয়াশিংটনের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি ২০০৩ সালের কথা বলছি। ততদিনে আফগানিস্তানে মার্কিনীদের দখলদারিত্ব আরম্ভ হয়েছে। বুশ প্রশাসন ন্যাটোর দখলদার বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপস্থিতির আকাঙ্ক্ষা জানালে সঠিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাতে সম্মত হন নাই যা ওয়াশিংটনের বিরক্তি বৃদ্ধি করেছিল। ভারত বিশ্ব ভূরাজনীতিতে মার্কিন প্রভুত্ব ও ইসলামবিদ্বেষের সেই সুযোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে ব্যাপক মাত্রায় তার এজেন্টদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়। এই অবস্থায় ২০০৫ সাল থেকেই সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারত এবং আওয়ামী প্রীতি বৃদ্ধি পেয়ে পর্যায়ক্রমে মইন-মাসুদের নেতৃত্বে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী বাংলাদেশে এক ভারতপন্থী অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে বহুল আলোচিত “মাইনাস টু” এর মাধ্যমে সেটিকে বিরাজনীতিকরণের পদক্ষেপ হিসেবে প্রচার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দিল্লির পুতুল ও দানব শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনাই ছিল সকল দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের মুখ্য উদ্দেশ্য।

বিএনপিকে দুই টুকরো করবার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে দিল্লির সাথে মিলে এক এগারো সরকার ২০০৮ সালের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে একচেটিয়াভাবে বিজয়ী করবার পরিকল্পনায় সফল হয়। তৎকালিন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ২০০৮ এর শুরুতে ভারত সফরে গিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতায় আনা এবং তার ব্যক্তিগত লাভের সকল বন্দোবস্ত করে আসেন। বিনিময়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব দিল্লির শাসকের চরণতলে বিসর্জন দেয়া হয়। সেই সময় কংগ্রেস ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। হয়ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত সকল জেনারেলরা সেদিন এভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়াকে সমর্থন না করলেও তারা কেউ সাহস করে প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদ করেন নাই। সকল জেনারেলদের সমভাবে অপরাধী সাব্যস্ত না করলেও যে সমস্ত প্রভাবশালী সামরিক কর্তারা ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে ভারতের কাছে দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিলেন তাদেরকে চিহ্নিত করা আবশ্যক। বিপ্লবী ছাত্র-জনতাকে সতর্ক করে বলছি, দেশদ্রোহীদের চিনতে না পারলে আগস্ট বিপ্লবের সফলতা ধরে রাখা কঠিন হবে। বাংলাদেশের জনগণের স্মৃতি ঝালিয়ে নেয়ার কাজে সহায়তার জন্য সেই সময়ের সেনাবাহিনীর মধ্যকার মূল অপরাধীদের একটা তালিকা দেয়ার চেষ্টা করছি:

১। জেনারেল মইন ইউ আহমেদ
২। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী
৩। মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন
৪। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মামুন খালেদ
৫। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি

সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে যে শেখ হাসিনা, ২০০৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ক্ষমতায় আসীন হলেন, তিনিই দুই মাস অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই বিডিআর বিদ্রোহের মোড়কে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। এ যেন আর এক পলাশী। ১৭৫৭ সালের সেই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ’র প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, সেনাপতি রায় দুর্লভ, এবং ইয়ার লতিফ খান দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এবার ২০০৯ সালে দেশবাসী অবাক হয়ে দেখলো যে, দুই দিন ধরে বিডিআর সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তাদের নির্বিচারে হত্যা এবং তাদের পরিবারের উপর অবর্ণনীয়, বর্বর নির্যাতন চললেও, ভারতীয় দালাল সেনাপ্রধানসহ নপুংসক জেনারেলরা কেবল নিরবে দেখে গেলেন। সেনাবাহিনীর চোখের সামনে, তাপস, নানক, ইনু, মেনন, সাহারা খাতুনরা বিনা বাধায় বিডিআর সদর দপ্তরে যাওয়া-আসা করতে পারলেও, সেনা সদস্যদের জন্য ঐ এলাকা “Out of Bound” হয়ে রইল। সব তারকা খচিত জেনারেলরা কাপুরুষের মত শেখ হাসিনার হুকুম তামিল করে গেলেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মর্যাদা ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে ভারতকে সহায়তা করলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল মইন সহ তৎকালিন সকল জি ও সি, ডিজিএফআই এর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সেনা সদর দপ্তরের সকল জেনারেলকে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে হয় সহযোগিতা অথবা নিষ্ক্রিয়তার জন্য অভিযুক্ত করতে হবে। নইলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

বিডিআর বিলুপ্ত করে বিজিবি গঠিত হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজিবি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনস্থ: হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান দিল্লি থেকে মনোনীত হওয়ার প্রথা চালু হয় এবং বাংলাদেশের ক্যান্টনমেন্টসমূহে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” (RAW) এর ব্যাপকহারে অনুপ্রবেশের অভিযোগ উঠতে আরম্ভ করে। জনগণের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে যায় যে, ডিজিএফআই এর সদর দপ্তরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের বিরাট অফিস খুলে ফেলেছে। সেই অফিসে কর্মরত ভারতীয় গোয়েন্দারা নাকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের উপর নজরদারি চালাতেন। এই পটভূমিতে ঢাকায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিল্লির পুতুল সরকারকে অনন্তকাল ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে একাধারে তিনটি ভুয়া নির্বাচনের বন্দোবস্ত করা হয়। সেই সব পাতানো নির্বাচনে প্রতিটি সেনাপ্রধান এবং ডিজিএফআই এর কর্তাব্যক্তি ও অন্যান্য প্রভাবশালী কর্মকর্তারা গণবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আগস্ট বিপ্লবকে সফল করবার জন্য এদের সবাইকে চিনে রাখা আবশ্যক।

১। ২০১৪ সালের “একদলীয়” নির্বাচনকালিন সেনাপ্রধান: জেনারেল ইকবাল করীম ভুঁইয়া
২। ২০১৮ সালের “মধ্যরাতের” নির্বাচনকালিন সেনাপ্রধান: জেনারেল আজিজ আহমেদ
৩। ২০২৪ সালের “ডামি” নির্বাচনকালিন সেনাপ্রধান: জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ

২০০৯ সাল পরবর্তী ডিজিএফআই প্রধানদের তালিকা যারা শেখ হাসিনার নির্দেশে ভিন্ন মত দমনে আয়নাঘর বানানোসহ সকল প্রকার নৃশংস মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এবং ভারতের তাবেদারি করেছে:

১। মোল্লা ফজলে আকবর
২। শেখ মামুন খালেদ
৩। মোহাম্মদ আকবর হোসেন
৪। মোহাম্মদ সাইফুল আবেদিন
৫। আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী
৬। হামিদুল হক

জনগণের সকল অধিকার হরণ করে বাংলাদেশকে এক নারকীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে উপরোক্ত সেনা কর্মকর্তাগণ প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে কেবল ফৌজদারি অপরাধই করে নাই, তারা দিল্লির কাছে মাথা বেঁচে দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহেরও অপরাধী। অবশ্যই এদের সকলের সেনা আইনে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সিভিল আইনে বিচার হতে হবে। বিডিআর ম্যাসাকারের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর পূর্বের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারে নাই। আগস্ট বিপ্লব সেনাবাহিনীকে তার সতেরো বছরের (২০০৭-২০২৪) পাপ মোচনের একটা সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সুযোগ সেনা বাহিনী গ্রহণ করবে কিনা তার জবাব পেতে হলে আমাদেরকে বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ্জামান একটি ভুল ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন। আইএসপিআর এর বিবৃতি অনুসারে সেনাবাহিনী প্রায় সাড়ে ছয়শ রাজনীতিবিদ এবং পুলিশ অপরাধীকে আশ্রয় দিয়েছিল যাদের হদিস এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। এই কারণে নানারকম দুর্নীতি এবং অবৈধ আর্থিক লেনদেনের গুজব জনগণ বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে। এই গুজব নিরসনের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকেই নিতে হবে। ক্যান্টনমেন্টে যাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল তাদের নামের তালিকা এবং বর্তমানে তাদের অবস্থানের বিষয়ে আইএসপিআর এর আর একটি দ্রুত বিবৃতি আমরা আশা করছি। অনেক হয়েছে। দয়া করে সেনাবাহিনীকে আর বিতর্কিত করবেন না।

লেখক: মাহমুদুর রহমান। সম্পাদক, আমার দেশ