সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। অগ্নিদুর্ঘটনার ভয়াবহতার চিত্র গণমাধ্যমের শিরোমান উঠে আসে। এতে কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। অনেকে তাদের অর্জিত সম্বল হারিয়ে পথে বসছে।

এরকমই এক ঘটনা ঘটেছে মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) সুনামগঞ্জের আশ্রায়ণ প্রকল্পের ঘরে আগুন লাগে একই পরিবারের ছয়জন নিহত হয়েছেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গড়ে দিনে ৭৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এসব আগুনের মধ্যে সর্বোচ্চ বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। এর পরই বিড়ি সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাসের লাইন থেকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এক বছরে অগ্নিকাণ্ডে সারা দেশে ২৮১ জন আহত ও ১০২ জন নিহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে আগুনের ঘটনায় ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২৭ হাজার ৬২৪টি আগুনের মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগে ৯ হাজার ৮১৩টি (৩৫.৫২%), বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ৪ হাজার ৯০৬টি (১৭.৭৬%), চুলা থেকে ৪ হাজার ১১৭টি (১৫.১১%), ছোটদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে ৯২৩টি (৩.৩৪%), গ্যাসের লাইন লিকেজ থেকে ৭৭০টি (২.৭৯%), গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ থেকে ১২৫টি (০.৪৫%) এবং বাজি পোড়ানো থেকে ৮৭টি ঘটনা ঘটে।

সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাসাবাড়ি-আবাসিক ভবনে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সারা দেশে বাসাবাড়িতে মোট ৬ হাজার ৯৫৬টি আগুন লাগে, যা মোট আগুনের ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। এছাড়া গোয়ালঘর ও খড়ের গাঁদায় ৪ হাজার ২৭৭টি, রান্নাঘরে ২ হাজার ৯৩৮, দোকানে ১ হাজার ৮২১, হাটবাজারে ১ হাজার ২৬৪, শপিং মলে ৭৫৯, পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ৪০৩, হাসপাতাল/ক্লিনিক/ফার্মেসিতে ২৪৮, হোটেলে ২৪৬, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে ২৩২, বস্তিতে ১৯৯, বহুতল ভবনে ১৪৭, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৪০, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ৯৬ ও পাট গুদাম-পাটকলে ৯৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

১৪ বছরে ঢাকায় যতো ভয়াবহ অগ্নি ট্র্যাজেডি: নীমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার ও বেইলি রোডের ট্রাজেডি বিশ্বজুড়ে মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। রাজধানীতে গত ১৪ বছরে ঘটে যাওয়া এ চারটি ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য মানুষের। এছাড়া, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ গত কয়েক বছরে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবার আগুন লাগার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। আশ্বাস দেয়া হয়, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। কিন্তু দৃশ্যপটে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না।

নিমতলী ট্র্যাজেডি: ২০১০ সালের ৩ জুন রাত ৯টার দিকে রাজধানীর চানখারপুলের নিমতলীতে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায় পাশের কেমিক্যালের গোডাউনে। মুহূর্তেই দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালে ঠাঁসা ওই এলাকার বেশ কয়েকটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। যখন ভয়ংকর সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান ১২৪ জন। আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা। নিমতলী ট্র্যাজেডি আলোড়ন ফেলেছিল দেশজুড়ে। আগুনে পুড়ে এতো সংখ্যক বীভৎস করুণ মৃত্যু যে স্মরণাতীতকালে দেখেনি বাংলাদেশ।

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি: ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যা ছড়িয়ে পড়ে সড়কে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেট কার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি ও মোটরসাইকেলে। কিছু বুঝে উঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে যেন মৃত্যুকূপ!

আগুন লাগার ১৪ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। তার আগেই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ৬৭ জনের। পরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১। এতে আহত হন কয়েকশ মানুষ।

এফআর টাওয়ার ট্র্যাজেডি: বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুর ১টায় লাগা আগুনে ২৭ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হয়। ২২তলা ওই ভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল।

মগবাজারের বিস্ফোরণ: ২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ হয়। আড়ংয়ের শোরুম ও রাশমনো হাসপাতালের উল্টো দিকের মূল সড়ক লাগোয়া সেই ভবন। ওই ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক ব্যক্তি। বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই বিকট ছিল যে প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা বলেছেন, এমন বিকট আওয়াজ তারা আগে তারা শুনেননি।

বেইলি রোড ট্র্যাজেডি: নীমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর ঢাকার ট্র্যাজেডির খাতায় বৃহস্পতিবার রাতে নাম লেখালো বেইলি রোড। আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিলো ৪৫টি নিরীহ-অসহায় প্রাণ। শুধু কি তাই? দগ্ধ হয়ে ১৮ জন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন।

বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুন: ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেদিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গত ১১ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। তারা বলেছে, মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এই ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার।

আগুন লাগলে করণীয় কী?
কোথাও আগুন লাগলে প্রথমেই আশপাশ থেকে দাহ্য বস্তু (সহজেই জ্বলে ওঠার মতো জিনিসপত্র) সরিয়ে ফেলতে হবে।

>> আগুনে অক্সিজেনের উৎস বন্ধ করতে হবে।

>> তেল থেকে আগুন লাগলে পানি দেওয়া যাবে না, বালু ছিটিয়ে দিতে হবে।

>> গ্যাস থেকে আগুন লাগলে দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে।

>> আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে পরে পানি দিয়ে ঠান্ডা করতে হবে।

আগে থেকেই সতর্ক থাকবো যেভাবে
>> রান্নার পর চুলার আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলতে হবে। গ্যাসের চুলা হলে ফুঁ দিয়ে না নিভিয়ে রান্না শেষ হলে চুলার চাবি ভালো করে বন্ধ করতে হবে।

>> গ্যাসের চুলা জ্বালানোর আগে অবশ্যই রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে নিতে হবে।
>> ভবনে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার, হোস পাইপ), দুই বালতি পানি ও বালু মজুত রাখতে হবে।

>> শিশুদের আগুন নিয়ে খেলা থেকে বিরত রাখতে হবে।

>> বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। বাধাহীনভাবে প্রবেশ করা যায়, এমন স্থানে স্থাপন করা যাবে না। দুর্ঘটনার শুরুতেই মেইন সুইচ বন্ধ করতে হবে।

>> দাহ্য বস্তু আছে, এমন স্থানে খোলা বাতির ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে।

>> ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে। প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং প্রয়োজন মুহূর্তে তা ব্যবহার করতে হবে।

>> অভিজ্ঞ ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে নিয়মিত ভবনের বৈদ্যুতিক ক্যাবল (তার) ও ফিটিংস পরীক্ষা করতে হবে।

>> অনুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটর থেকে মানসম্মত গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে হবে। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের আগে লেবেল ও মেটেরিয়াল সেফটি ডাটা শিট পড়ে নিতে হবে।

>> খোলা আগুন দিয়ে নয়, সাবানের ফেনা দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারের লিকেজ পরীক্ষা করতে হবে।

>> প্রতি তিন বছর পরপর সিলিন্ডারের হাইড্রোলিক প্রেসার টেস্ট করা হয়েছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হবে।

>> এসি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার চালুর আগে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।

ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কিনা বুঝবো কীভাবে?
কোনও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কিনা সেটা কীভাবে জানা যাবে, দেখে বোঝার উপায় আছে কিনা– জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস জানায়, অগ্নি নিরাপত্তার দিক থেকে কোনও কোনও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। সেটা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা পরিদর্শন করলেই বুঝতে পারেন। তবে ভবন ভেঙে পড়ার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস আগে কিছু বলতে পারে না। ভবন নির্মাণের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলীরা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসে এ বিষয়ক কোনও বিশেষজ্ঞ (প্রকৌশলী) নেই।

তবে অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্পের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে আগে থেকে সর্তকতা নেওয়া যেতে পারে এমন কয়েকটি বিষয় তিনি জানান-

>> বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তা জানতে হবে।

>> ভবনের ঝুঁকি পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে।

>> বহুতল ভবনে যদি প্রবেশ ও বের হওয়ার গেট একটা থাকে, তবে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ।

>> বহুতল ভবনে যদি অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম না থাকে সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ।

>> ভবনে বের হওয়ার একাধিক গেট আছে, কিন্তু সেগুলো মালামাল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে, এটাও ঝুঁকিপূর্ণ।

এসব বিষয় নজরে রেখে ভবন নির্মাণ করলে মানুষের জীবনের ঝুঁকি কমে যাবে, এছাড়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমে আসবে বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, একটা ভবন বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এটা খারাপ না ভালো। এটা ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা ছাড়া বোঝার উপায় নেই। এভিডেন্স দরকার, ক্যালকুলেমন করে দেখাতে হবে যে বিল্ডিংটা ঝুঁকিপূর্ণ।

পুরান ঢাকার মতো ঘিঞ্জি এলাকা খারাপ এরকম কথা আন্দাজে বলা হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। পরীক্ষা করা ছাড়া এটা বলা যাবে না বলে অভিমত দেন তিনি। ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে এমন বিশেষজ্ঞরাই কোনও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কিনা বা কোনও অবকাঠামো পরিত্যক্ত ঘোষণা করা যাবে কিনা সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারবেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।