সাবিলা নূর: বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পীরা বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। নাটক, চলচ্চিত্র, মঞ্চ, কিংবা ওয়েব সিরিজ—প্রতিটি মাধ্যমেই শিল্পীরা প্রতিদিন নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে কাজ করছেন। একদিকে শিল্পের প্রতি তাদের ভালোবাসা, অন্যদিকে আর্থিক অনিশ্চয়তা ও সম্মানের অভাব, এ দুইয়ের মাঝে নিজেদের ভারসাম্য বজায় রাখা সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে এই সময়ের অভিনয়শিল্পীদের মূল সমস্যাগুলো নিয়ে, যা তাদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।

১. শেখার সুযোগের ঘাটতি
বাংলাদেশের বিনোদন জগতে শিল্পীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার সুযোগ সীমিত। অভিনয়শিল্পে দক্ষতা অর্জন করতে হলে নিয়মিত অনুশীলন এবং পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশে এমন প্রতিষ্ঠান বা একাডেমি কম যেখানে অভিনয়শিল্পীরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। বেশিরভাগ শিল্পী তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় শিখছেন এবং সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে ভুগছেন। উচ্চমানের প্রশিক্ষণ ও দীক্ষার অভাবের কারণে নতুন শিল্পীদের মধ্যে অভিনয়ের গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করার মতো যোগ্যতা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতে অনেক জাতীয় ইনিস্টিউট আছে, কিন্তু বাংলাদেশে সত্যিকারের অভিনয় শেখানোর প্রতিষ্ঠান নেই।

২. আর্থিক অনিরাপত্তা

বাংলাদেশে অভিনয়শিল্পীরা আর্থিকভাবে যথেষ্ট নিরাপত্তার মুখোমুখি নন। অধিকাংশ শিল্পীই অনিয়মিত আয় ও সীমিত সম্মানীর কারণে আর্থিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। নাটক বা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পরেও অনেক শিল্পী তাদের পারিশ্রমিক সময়মতো পান না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক অনেক কম দেওয়া হয়, যা তাদের জীবনযাত্রা বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে অনেক শিল্পী তাদের পেশা ছেড়ে অন্য কোনো আয়ের উৎসের সন্ধান করতে বাধ্য হন। এই আর্থিক অনিশ্চয়তা অনেক প্রতিভাবান অভিনেতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের সৃষ্টিশীলতার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।

৩. নতুন প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। ডিজিটাল মিডিয়ার প্রসারের কারণে অভিনয়শিল্পীদের নতুন নতুন প্রযুক্তি ও মিডিয়াতে অভ্যস্ত হতে হচ্ছে। ক্যামেরা, এডিটিং সফটওয়্যার, গ্রাফিক্স, অডিও ইফেক্ট—এসব ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রয়োজন, যা অনেক শিল্পীর নেই। অনেকেই এই প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবে পিছিয়ে পড়ছেন। এছাড়া, নতুন মাধ্যম যেমন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কাজ করার সুযোগ থাকলেও এই মিডিয়ায় সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা তাদের নেই। ফলে এই মাধ্যমেও তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন।

৪. বিদেশে কাজের সুযোগ কম

বাংলাদেশি শিল্পীদের জন্য বিদেশে কাজের সুযোগ বেশ সীমিত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ থাকলেও সেই সুযোগ গ্রহণের মতো সুযোগ-সুবিধা ও সংযোগের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি, ভাষার প্রতিবন্ধকতা, প্রযোজক বা পরিচালকদের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের সীমাবদ্ধতা, এবং পেশাগত যোগাযোগের অভাবে বিদেশে কাজ করার সুযোগ তেমন পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, ভারতসহ অন্যান্য দেশের শিল্পীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের পরিচিতি বাড়িয়ে নিচ্ছেন, যেখানে বাংলাদেশি শিল্পীরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

৫. সম্মানীর অভাব

বাংলাদেশে অনেক অভিনয়শিল্পীই যথাযথ সম্মানী পান না। নাটক, টেলিভিশন বা চলচ্চিত্রে কাজের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পীদের যথাযথ পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না, যা একটি বড় সমস্যা। অনেক পরিচালনা প্রতিষ্ঠান শিল্পীদের সম্মানী কমাতে চায়, যা শিল্পীদের মর্যাদার সাথে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি শুধু আর্থিক নিরাপত্তা নয়, বরং শিল্পীদের কাজের প্রতি সম্মানের অভাবকেও নির্দেশ করে। এই কারণে অনেক প্রতিভাবান শিল্পী তাদের পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

৬. পর্যাপ্ত কাজের অভাব

বাংলাদেশের বিনোদন জগতে কাজের সুযোগ সীমিত। বিশেষ করে নতুন শিল্পীদের জন্য কাজ পাওয়ার চ্যালেঞ্জ বেশি। একজন নতুন শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক চেষ্টার প্রয়োজন হয়। তবে নির্মাতারা সাধারণত অভিজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কাজের সুযোগ বেশি দেন, যার ফলে নতুনদের জন্য সুযোগ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, শিল্পের মানের ক্ষেত্রেও চাহিদা ও যোগানের অসামঞ্জস্য দেখা যায়, ফলে সব শিল্পী নিয়মিত কাজ করতে পারেন না।

৭. নেটওয়ার্কিংয়ের সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশের বিনোদন জগতে নেটওয়ার্কিং একটি বড় ভূমিকা পালন করে। কার সাথে পরিচয় আছে, কার দ্বারা কাজ পাওয়া যাবে—এমন সব বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক প্রতিভাবান শিল্পী শুধু নেটওয়ার্কিংয়ে পিছিয়ে থাকায় ভালো কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। যোগসূত্রের অভাবে ভালো স্ক্রিপ্ট বা পরিচালকের সাথে কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় তাদের ক্যারিয়ার সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে না।

৮. সৃষ্টিশীলতার বিকাশে বাধা

বাংলাদেশের বিনোদন জগতে সৃষ্টিশীলতার বিকাশেও বাধা রয়েছে। একদিকে আর্থিক চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে বিনোদন জগতের নির্দিষ্ট মানসিকতার কারণে নতুন ধারার কাজ করার সুযোগ কম। সাধারণত, ব্যবসায়িক স্বার্থে কাজের মান বা কনটেন্টের বিষয়বস্তু সীমিত রাখা হয়, ফলে শিল্পীদের সৃষ্টিশীলভাবে কাজ করার সুযোগ কমে যায়। উদ্ভাবনী ধারার কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও প্রযোজক বা পরিচালকের চাহিদার সাথে মিল রেখে কাজ করতে হয়, যা সৃষ্টিশীলতার বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

৯. মানসিক চাপ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি

অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানসিক চাপ। কাজের অনিয়মিত সময়, আর্থিক অনিশ্চয়তা, এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। তাছাড়া, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা ও সুযোগের অভাবও তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

১০. সমাধানের জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথমত, শিল্পীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এই বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। অভিনয়শিল্পীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সংগঠন বা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যা শিল্পীদের সম্মানী এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে।

নতুন প্রযুক্তি ও মাধ্যমের সাথে শিল্পীদের পরিচিত করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা যেতে পারে। সেই সাথে, আন্তর্জাতিক সুযোগ গ্রহণের জন্য শিল্পীদের যোগ্য করে তোলা জরুরি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শিল্পীদের সম্মানের সাথে কাজ করার একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে তারা নিজেদের সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারবেন। এই চ্যালেঞ্জগুলো দূর করতে না পারলে, বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পীদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে পড়বে। শিল্পীরা যদি সম্মান, সুযোগ এবং সঠিক পরিবেশ পান, তাহলে তারা নিজেদের সেরাটা দিতে সক্ষম হবেন, যা বাংলাদেশের বিনোদন জগতকে আরও সমৃদ্ধ করবে। সূত্র : খবর সংযোগ

লেখক: জনপ্রিয় মডেল ও অভিনেত্রী