গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরচার সরকার পতনের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য (এমপি), দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

এরই মধ্যে অনেকে গোপনে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। দালাল ও ইমিগ্রেশনকে ‘ম্যানেজ’ করে পালাতে গিয়ে প্রতারণার শিকার কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হচ্ছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ছাড়া অধিকাংশ ব্যক্তি দেশ ছাড়ার জন্য ভারত সীমান্ত বেছে নিয়েছেন। সেখান থেকে নানা গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন তারা। তাদের পারাপারের কাজে বিভিন্ন সীমান্তে গড়ে উঠেছে একাধিক চক্র। এ চক্রের সদস্যরা প্রভাবশালীদের পার করে দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ অবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এমন বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকা সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। জোরদার করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টহলও।

সূত্র বলছে, সীমান্ত দিয়ে দেশত্যাগ করা ব্যক্তিরা যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সিলেট, দিনাজপুরের হিলি ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা সীমান্ত ব্যবহার করেছেন। সীমান্ত পার হয়ে তারা ভারতের ত্রিপুরা, আগরতলা, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে অবস্থান নিয়েছেন। সেখান থেকে কেউ দুবাই, কেউ জার্মানি, কেউবা যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে সীমান্তে আটকে যাওয়ার সংখ্যাও কম নয়।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ভোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া-আগরতলা সীমান্তের আব্দুল্লাহপুর এলাকা থেকে চট্টগ্রাম-৬ আসনের সাবেক এমপি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীসহ তিনজনকে আটক করে বিজিবি। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই নেতা প্রায় ২ কোটি টাকার বিনিময়ে ভারতে যাওয়ার রফাদফা করেছিলেন। তবে তিনি আটকে গেলেও এ সীমান্ত দিয়ে পাড়ি দিতে পেরেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ব্যাটালিয়ন ২৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারাহ মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, ‘ফজলে করিম চৌধুরীর কাছে টাকা, পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। কী পরিমাণ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে তাকে ভারতে পাচার করা হচ্ছিল, তা সঠিকভাবে বলতে পারব না।’

কে কোন পথে দেশ ছেড়েছেন: ইমিগ্রেশন পুলিশ ও সীমান্ত এলাকা সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অনেক নেতা গোপনে দেশ ছেড়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও গোপালগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমান, সাবেক এমপি কাজী জাফর উল্যাহ, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, চাঁদপুরের সাবেক এমপি মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যরাও দেশ ছেড়েছেন। তাদের অনেকে আকাশপথে গেছেন। আবার সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তার মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসীন বাহার সূচনা কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন বলে শোনা গেছে। যশোরের স্থানীয় লোকজন বলছেন, ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন যশোরের শার্শার এমপি শেখ আফিল উদ্দিনও। শুধু তা-ই নয়, আফিলের সহযোগিতায় ভারতে গেছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও খুলনার সাবেক এমপি এস এম কামালও। পুটখালী সীমান্ত দিয়ে ভারতে গেছেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের সুরইঘাট এলাকার সনাতনপুঞ্জি দিয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল।

অবৈধভাবে কেউ যাতে ভারতে যেতে না পারেন, সে জন্য বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির ৬০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এ এম জাবের বিন জব্বার। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাবেদুর রহমান জানান, সন্দেহভাজন কারা কারা পালাতে পারেন, তাদের একটা তালিকা আছে। এ তালিকা ধরে প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের ট্র্যাকিং করা হচ্ছে।

যেসব পুলিশ কর্মকর্তার দেশত্যাগের খবর: রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন ও রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। পুলিশের সাবেক এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম বিদেশে চলে গেছে বলে শোনা গেলেও গতকাল থেকে তাকে ফেসবুকে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। অবশ্য একটি গণমাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেছেন, দেশেই আছেন। এ ছাড়া বিদেশে চলে যাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের। তাদের সবার বিরুদ্ধে অন্তত ৩০টি করে হত্যা মামলা রয়েছে।

জয়পুরহাট ২০ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল নাহিদ নেওয়াজ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে কেউ যাতে ভারতে ঢুকতে না পারেন, এ বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারিসহ লোকজন বৃদ্ধি করেছি।’

দুই দেশের ইমিগ্রেশন সিল, সই নকল: সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যেসব নেতা-কর্মী, কর্মকর্তা ও অপরাধী সীমান্ত পথে ভারতে যাচ্ছেন, তাদের পাসপোর্ট ও ভিসা রয়েছে। তবে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট জমা দিলে ধরা খাওয়ার ভয়ে তারা অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন। যেহেতু ভিসা ছাড়া কলকাতায় হোটেলে অবস্থানের সুযোগ নেই, তাই দালাল চক্র তাদের পাসপোর্টে এপার-ওপারের নকল ইমিগ্রেশন সিল লাগিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দালাল চক্র তাদের বিশ্বস্ত প্রেস থেকে এসব সিল বানিয়ে থাকে বলে জানা গেছে। তবে যাদের পাসপোর্ট-ভিসা নেই, তারা কলকাতা এবং তার আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ফ্ল্যাটে উঠছেন। সূত্র বলছে, সীমান্তে দালালেরা সব মিলিয়ে এমপি, মন্ত্রী, পুলিশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাঠাতে ১০ লাখ, অন্যদের ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকায় চুক্তি করছে। আবার অনেকে টাকা দেওয়ার পরও যেতে পারেননি, এমন নজির রয়েছে।

সীমান্তে আটক যারা: ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল আহমদকে আটক করে বিজিবি। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। একই দিন কানাইঘাটের দনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান ও লিয়াকত শেখ আটক হন। গত ২৮ আগস্ট একই সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার মৃত্যু হয়। তবে ভারতের পুলিশ জানিয়েছে, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী পান্নার মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধে। এর আগে ২৩ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাটের দনা সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে আটক করে বিজিবি।

সম্প্রতি ফেনী-২ আসনের সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর ব্যক্তিগত সহকারী ফরিদ ওরফে পিএস মানিককে আটক করে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পুলিশ। গত রোববার মধ্যরাতে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার জন্য একটি প্রাইভেট কারে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সীমান্তে পৌঁছালে একাত্তর টেলিভিশনের (সিইও) মোজাম্মেল হক বাবু, দৈনিক ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তসহ চারজনকে আটক করে পুলিশ।

সরাইল ব্যাটালিয়নের (২৫ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল ফারাহ মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন সীমান্তপথে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার সময় অন্তত ৩৩ জনকে আটক করেছে বিজিবি। সীমান্তে সবাই সতর্ক রয়েছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, গোপনে এভাবে দেশছাড়া কারও জন্যই ভালো বার্তা দেয় না। তাদের উচিত ছিল, দেশে থেকে আইনিভাবে সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। দেশত্যাগ মানে দেশের জন্য ওই সব ব্যক্তির আগে যে ভূমিকা ছিল, সেগুলো সঠিক ছিল না। তা ছাড়া কিছু লোক পালিয়ে বাঁচলেও দেশে থাকা ওই শ্রেণি-পেশার অন্য মানুষেরা বিপদে পড়বে। তবে এ ক্ষেত্রে চলমান যে ‘মব জাস্টিস’ সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, তা রাষ্ট্রকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে দেশ ছাড়া ঠেকানো যাবে না।