লাইফস্টাইল ডেস্ক: একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার হচ্ছে মাতৃত্ব। একজন নারীর জীবনে পরিপূর্ণতার স্বাদ বয়ে আনতে পারে মাতৃত্বর মাধ্যমে। সন্তানের আগমনী বার্তা থেকে শুরু করে প্রসব যন্ত্রণার পুরোসময়টা নারীর জন্য আনন্দের। একজন মা আনন্দের সঙ্গেই মায়াভরা স্বপ্ন নিয়েই উপভোগ করেন এই সময়।

এই চিত্রটি সবার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা যায় না। অনেকের জীবনে এর বিপরীত অবস্থাও আসতে দেখা যায়। সন্তানের প্রসবের পর সাত রাজার ধন হাতে পেয়েও কেউ হয়তো সুখসাগরে ভাসতে পারেনা। কখনো কখনো মাতৃত্বের আনন্দ অনেক নারীর জীবনে বিষাদময়তায় পরিণত হতে পারে।

শুনতে অবাক লাগলেও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মায়ের ক্ষেত্রেই অন্তত এক-দুইবার এমন পরিস্থিতি হয়েছে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একজন নারীকে আট-নয় মাস বা তারও বেশি সময় ধরে যে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয়, তার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তখন প্রসবের দু’-তিনদিন পর থেকেই অনেক মায়ের মুডসুইং হয়। এর ফলে তার মেজাজ পরিবর্তন, কান্না কান্না ভাব, উদ্বেগ, রাতে ভালো ঘুম না হওয়া প্রভৃতি সমস্যা হতে শুরু করে।

প্রসব: সাধারণত দুই সপ্তাহ পর্যন্ত একজন নতুন মাকে এসব সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে অনেক নতুন মায়ের ক্ষেত্রে এসব সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী হয়, এবং সমস্যার মাত্রাও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হয়। সেক্ষেত্রে নতুন মায়ের বিষণ্ণতা যখন চরম মাত্রায় পৌঁছায়, তখন এ পর্যায়টিকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হিসেবে ধরা হয়।

নতুন মায়েদের এ পর্যায়ের মানসিক বিপর্যয় বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা করেছেন মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।

যারা প্রথম সন্তানের জন্ম দেন বা নতুন মা হন তাদের মধ্যে শতকরা ৮৫ শতাংশই কোনো কারণ ছাড়াই বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। যেমন হুট করেই এসব মায়েরা কাঁদবেন, হাসবেন, ঝগড়া করবেন, জিদ করবেন, বিষণ্ণ হবেন। এটা কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যায়। যদি কারো বেলায় ঠিক না হয় তখনই সেটি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের দিকে যায়। বাংলায় এ রোগটিকে বলা হয় মাতৃত্বকালীন বিষণ্নতা।

যেহেতু সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একজন নারীকে প্রচুর শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয়। ফলে সন্তান জন্মদানের ওই সময় ও কিছু পরে তার মন স্বাভাবিকের চেয়েও কোমল ও স্পর্শকাতর থাকে। আর ঠিক সেই সময়টাতেই তার উপর বিষণ্ণতা ভর করে। এতে অনেকে খুব ঘাবড়েও যান। তখন তিনি নিজের উপর অহেতুক সন্দেহ করতে থাকে।

সেক্ষেত্রে জেনে থাকা ভালো যে, মাতৃত্বকালীন বিষণ্ণতা মোটেই কোনো চারিত্রিক ত্রুটি বা দুর্বলতা নয়। দীর্ঘ ন’মাস ধরে এত কষ্ট, এত শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করার পর, কিছুদিন যদি কেউ মানসিকভাবে দুর্বল বোধ করেন, তাতে দোষের কিছুই নেই।

তবে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে সেটির চিকিৎসা নিয়ে নিলেই দ্রুততম সময়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব। এমনকী সন্তানের সাথে চমৎকার বন্ধনও গড়ে তুলাও সহজ।

লক্ষণ: পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো সন্তান জন্মদানের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা দেয়। তবে অনেকের ক্ষেত্রে আরো আগে, যেমন গর্ভাবস্থাতেই, আবার অনেকের ক্ষেত্রে অনেক পরে, যেমন সন্তান জন্মদানের বছরখানের পরেও, এসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দেয়:

মন সবসময়ই বিষণ্ণ থাকা,মেজাজ অনেক তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হতে থাকা, বাচ্চার সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে সমস্যা হওয়া, স্বাদহীনতার কারণে একেবারেই খেতে না পারা, স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বেশি খেয়ে ফেলা, একেবারেই ঘুমাতে না পারা (ইনসমনিয়া), অনেক বেশি বেশি ঘুমানো,যেকোনো বিষয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়া, কোনো বিষয়ে একদমই আগ্রহ অনুভব না করা, আগে যেসব কাজ উপভোগ্য ছিল, সেগুলোও ভালো না লাগা,মেজাজ খিটখিটে থাকা এবং অল্পতেই রেগে যাওয়া, নিজেকে মা হিসেবে খারাপ ভাবা অর্থাৎ ‘আমি ভাল মা নই’ জাতীয় অনুভূতি হওয়া,হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়া, নিজেকে নিয়ে লজ্জিত, বিব্রত বোধ করা এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা,কোনো বিষয়ে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে না পারা,কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে না পারা, যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোলাচলে ভোগা, সবসময় অস্থির অনুভব করা, প্রচণ্ড উদ্বেগ অনুভব করা, প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হওয়া, নিজের কিংবা সন্তানের ক্ষতি করার চিন্তা করা, বারবার মৃত্যু কিংবা আত্মহত্যার কথা ভাবা।

প্রসব: পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন অনেকের ক্ষেত্রে খুবই চরম মাত্রায় ধারণ করলে তাকে পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস বলা হয়। এক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা দেয়:

সবসময় বিভ্রান্ত থাকা, কাউকে সহজে চিনতে না পারা।
সন্তানের ব্যাপারে অবসেশনে ভুগতে থাকা।
সম্মোহিত কিংবা ভ্রমের মধ্যে থাকা।
ঘুমের চরম ব্যাঘাত হওয়া।
মাত্রাতিরিক্ত শারীরিক শক্তি অনুভভ করা এবং উত্তেজিত থাকা।
প্যারানয়া বা মস্তিষ্কবিকৃতির শিকার হওয়া।
বারবার নিজের বা সন্তানের ক্ষতি করতে উদ্যত হওয়া।

পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তি বারবার মৃত্যু-চিন্তা করতে থাকে, নিজের আচার-আচরণেও সেগুলো প্রকাশ পায়, এবং যথাসময়ে চিকিৎসা না করা হলে তার জীবন সত্যি সত্যিই হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে।

যদি কোনো নতুন মা বা সন্তান-সম্ভবা নারী বিষণ্নতার শিকার হয়, তবে তার উচিত হবে সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নেওয়া।

যাদের বিষণ্ণতার ইতিহাস আছে, সন্তান জন্মদানের পরপরই তাদের উচিত হবে, আবারো চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ভালোভাবে নিজের মানসিক চেক-আপ করিয়ে আসা। যদি তখনই কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ ধরা পড়ে, তাহলে আগেভাগেই চিকিৎসা শুরু করে দেয়া যাবে, এবং নতুন মা ও সন্তান কারো উপর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আগেই সমস্যাটিকে দূর করে ফেলা সম্ভব হবে।