ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে  শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সুদখোর বলে গালি দিয়ে রাগ ঝাড়তেন। ক্ষমতায় থাকার সময় বেশির ভাগ সময়ে ইউনূসকে ‘সুদখোর’ বলে ব‍্যঙ্গ করতেন। অথচ সেই শেখ হাসিনাই গত ১৫ বছরে ব‍্যাংক সুদ থেকে আয় করেছেন লাখ লাখ টাকা।

শুধু তাই নয়, প্রচলিত আইনভঙ্গ করে পূর্বাচলে নিজের নামে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রতি মেয়াদেই শেখ হাসিনার আয় বেড়েছে উল্লেখযোগ‍্য হারে। গত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামায় এসব তথ‍্য প্রকাশ করেছেন তিনি নিজেই।

নির্বাচনের আগে আটটি তথ‍্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনে হলফনামা জমার বিধি-বিধান রয়েছে। শেখ হাসিনার নির্বাচনি চারটি হলফনামা বিশ্লেষণ করে তাঁর আয়, দায়, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, মামলা এবং অন‍্যান‍্য বিষয়ে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ‍্য পাওয়া যায়, যা তুলে ধরা হলো :

সুদ থেকে নিয়মিত আয় করতেন শেখ হাসিনা: শেখ হাসিনার ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লষণ করে দেখা যায়, নির্দিষ্ট বছরগুলোতে তিনি সঞ্চয়পত্র ও ব‍্যাংকে জমাকৃত আমানত, এফডিআর থেকে নিয়মিতই অর্থ আয় করেছেন। সেই আয়ের বিবরণী তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।

ক্ষমতাচ‍্যুত প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালের হলফনামায় দেখিয়েছেন শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব‍্যাংক আমানত থেকে বছরে ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৬৭ টাকা আয় করেছেন। ২০১৩ সালে দাখিল করা হলফনামায় দেখা যায় তিনি শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব‍্যাংক আমানত থেকে বার্ষিক আয় করেছেন ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ১৮৫ টাকা। ২০১৮ সালে একই উৎস থেকে তিনি ১২ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালের নভেম্বরে দাখিল করা হলফনামায় শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব‍্যাংক আমানত থেকে বছরে আয় দেখিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা এবং এফডিআর ও ব‍্যাংক সুদ থেকে ৩২ লাখ ২৫ হাজার ৩৪৬ টাকা।

ব‍্যাংকে জমা রাখা অর্থের ওপর ব‍্যাংক সাধারণত সুদই (ইন্টারেস্ট) লভ‍্যাংশ হিসেবে দিয়ে থাকে। তবে শেখ হাসিনার কত টাকা থেকে এই অর্থ উপার্জন করেছেন, তা হলফনামায় উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি তাঁর আমানত কোন ব‍্যাংকে গচ্ছিত ছিল, সেটাও জানা যায়নি।

প্রতি মেয়াদে শেখ হাসিনার আয় বেড়েছে: ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার কৃষি খাত, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন‍্যান‍্য ভাড়া, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব‍্যাংক আমানত থেকে বার্ষিক আয় ছিল ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭ টাকা।

২০১৩ সালে দাখিল করা হলফনামায় এ আয় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে হয় ৭০ লাখ ১৪ হাজার ১০ টাকা। আয়ের উৎস হিসেবে কৃষি খাত, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন‍্যান‍্য ভাড়া, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব‍্যাংক আমানতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৎস‍্যখামার, চাকরি এবং গাছ বিক্রয়ের আয়।

২০১৮ সালের হলফনামায় আয় আরও বেড়ে হয় ৭৬ লাখ ৭২ হাজার ৬৩৪ টাকা। আয়ের উৎস ছিল কৃষি খাত, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন‍্যান‍্য ভাড়া, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব‍্যাংক আমানত, ব‍্যবসা (রয়্যালিটি) এবং অন‍্যান‍্য খাত।

২০২৪ সালে হাসিনার বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৬ হাজার ৯ হাজার ৩৪৬ টাকা। আয়ের উৎস ছিল কৃষি খাত, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব‍্যাংক আমানত, চাকরি, এফডিআর ও ব‍্যাংক সুদ এবং রয়‍্যালিটি। তবে এ বছর বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন‍্যান‍্য ভাড়া থেকে কোনো আয় দেখানো হয়নি।

ব‍্যাংক স্থিতিতে উত্থান-পতন: ২০০৮ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শেখ হাসিনার জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ১৮ লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ টাকা। ২০১৩ সালে জমার পরিমাণ দেখানো হয় ১ কোটি ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮৩৫ টাকা। ২০১৮ সালে জমার পরিমাণ দেখানো হয় ৭ কোটি ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৩০৩ টাকা, যা পূর্ববর্তী নির্বাচনি হলফনামায় দাখিল করা অর্থের প্রায় ৭ গুণ। ২০২৩ সালে জমা করা অর্থের পরিমাণ আবার কমে দাঁড়ায় ২ কোটি ৩৮ লাখ ৯৮ হাজার ৬০৭ টাকা।

কৃষি খাতে আয়েও উত্থান-পতন: ২০০৮ সালে কৃষি খাত থেকে শেখ হাসিনার বার্ষিক আয় ছিল সাড়ে ৪ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের হলফনামায় দেখানো হয় ৭৫ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে কৃষি খাত থেকে আয় দেখানো হয় ৩ লাখ টাকা। আর ২০২৩ সালে প্রায় তিন গুণ বেড়ে আয় হয় ৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।

শেষ নির্বাচনের আগে হাতে ছিল মাত্র সাড়ে ২৮ হাজার টাকা: ২০০৮ সালে দাখিল করা হলফনামায় দেখা যায়, শেখ হাসিনার কাছে নগদ দেড় লাখ টাকা ছিল, ২০১৩ সালে ছিল ৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, ২০১৮ সালে ছিল ৮৪ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালে ছিল মাত্র সাড়ে ২৮ হাজার টাকা।

১৫ বছর স্বর্ণ কেনেননি এক রতিও: নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, শেখ হাসিনার স্বর্ণ, অন্যান্য মূল্যবান ধাতু ও পাথর নির্মিত অলংকারের মূল‍্য ছিল ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে তিনি কোনো স্বর্ণ, মূল্যবান ধাতু বা অলংকার কেনেনি।

কোনো আসবাবপত্র কেনা হয়নি: চারটি হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কোনো আসবাবপত্র কেনেননি শেখ হাসিনা। প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছিলেন, তাঁর ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকার আসবাবপত্র রয়েছে। এই ১৫ বছরে তিনি কোনো আসবাবপত্রও কেনেননি।

নিজের কোনো ঋণ নেই, রাষ্ট্রের ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণ: ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত চারটি সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার দাখিল করা প্রতিটি হলফনামায় দেখা যায়, তিনি একক, যৌথভাবে বা তাঁর ওপর নির্ভরশীল কোনো সদস্য অথবা কোনো ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা ডিরেক্টর হওয়ার সুবাদে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ঋণ নেননি। তবে ১৫ বছর শেখ হাসিনা ব‍্যক্তিগতভাবে কোনো ঋণ না নিলেও, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সম্প্রতি জানিয়েছে, এই সময়ে রাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণ। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। আর তিনি ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার সময় দেশি ও বিদেশি যে ঋণের বোঝা রেখে গেছেন, তা স্থানীয় মুদ্রায় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো।

২১ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি: ২০০৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী, শেখ হাসিনার মোট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৪ হাজার ৯০৩ টাকা। ২০১৩ সালের হলফনামায় এ সম্পত্তির পরিমাণ দেখানো হয়েছে, ৬ কোটি ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫০ টাকা। ২০১৮ সালে এ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭ কোটি ৬১ লাখ ৯ হাজার ৭৮৭ টাকা। তবে, ২০২৪ সালের হলফনামায় এ সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৭১ হাজার ১০৭ টাকা।

রাজউক আইন ভঙ্গ করে পূর্বাচলে প্লট: ক্ষমতার ১৫ বছরে বহুবার জোর গলায় ‘রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি … ’, ‘আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই’ বললেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নতুন শহর পূর্বাচল প্রকল্পে শেখ হাসিনা তাঁর পুরো পরিবারের নামে মোট ৬০ কাঠা জমি বরাদ্দ নেন। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে ২০২২ সালের ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছোট বোন শেখ রেহানা ও তাঁর দুই সন্তান রেদওয়ান সিদ্দিক ববি ও মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের নামে ১০ কাঠা করে প্লট বরাদ্দ নেন। তবে ২০২৪ সালের হলফনামায় শুধু শেখ হাসিনার নামে বরাদ্দ করা প্লটের কথা উল্লেখ আছে, যার মূল‍্য দেখানো হয় ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

রাজউকের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ঢাকায় কেউ সরকারি সম্পত্তি বরাদ্দ পেলে তিনি আর রাজউকের প্লটের জন্য আবেদন করার যোগ‍্য হবেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা সেটি না মেনে নিজের নামে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। এরপরও তিনি রাজউক আইনের ব‍্যত‍্যয় করে পরিবারের অন‍্য সদস‍্যদের জন‍্য ৫০ কাঠা জমির প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন।

এর আগে শেখ হাসিনা ক্ষমতা থাকার সময় ২০০১ সালের ২০ জুন ‘জাতির পিতার পরিবার সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০১’ পাস করিয়ে নেন। ওই আইনে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আজীবন এসএসএফের নিরাপত্তা, পৃথক আবাসন বরাদ্দ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়। এই আইনবলে ২০০১ সালের ২ জুলাই গণপূর্ত অধিদপ্তর শেখ হাসিনাকে গণভবন বরাদ্দ দেয় এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানাকে ধানমণ্ডির ৬ নম্বর সড়কে এক বিঘার একটি সরকারি বাড়ি বরাদ্দ দেয়। পরে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আইনটি এবং আবাসন বরাদ্দ বাতিল করে।

পরে নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালে ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা বিল-২০০৯’ সংসদে পাস করিয়ে নেন শেখ হাসিনা। ওই আইনের আওতায় জাতির পিতার পরিবারের জীবিত সদস্যদের জন্য আজীবন বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া এ পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথাও বলা হয়। ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে শেখ হাসিনা পালানোর পর তিনি ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা ও আবাসন সুবিধা বাতিল করা হয়।

খুন-দুর্নীতির ১৬ মামলা বাতিল: দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মারামারি, হত্যাসহ ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা করা হয়েছিল। তার মধ‍্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছিল ১১টি। বাকি ৫টি মামলা ছিল চাঁদাবাজি, মারামারি ও হত্যার। এসব মামলার মধ্যে আলোচিত নাইকো দুর্নীতি মামলার মূল আসামি ছিলেন শেখ হাসিনা, কারণ নাইকো কোম্পানির সঙ্গে তিনি চুক্তি করেছিলেন। এ ছাড়া মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয়, ফ্রিগেট (যুদ্ধজাহাজ) ক্রয় দুর্নীতি মামলা, মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা এবং ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা এবং বেপজায় পরামর্শক নিয়োগের মামলা।

২০২৩ সালে দাখিল করা হলফনামায় দেখা যায়, ২০১০ সালে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ শেখ হাসিনার ৯টি মামলা বাতিল করেন। আর ৬টি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়। মানহানির একটি মামলা তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় আর এগোয়নি।