মাহমুদুর রহমান: ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জনগণ সর্বশেষ স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছিল। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেই নির্বাচন স্বাধীন হলেও, নির্বাচনটি মোটেও স্বচ্ছ ছিল না। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন যে, নির্বাচনের মাস দশেক আগেই বাংলাদেশের তৎকালিন সেনাপ্রধান জেনারেল মইনউদ্দিনের ভারত সফরকালে তার সাথে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জেতানোর বিষয়ে শলাপরামর্শ হয়েছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতা পেলে জেনারেল মইনের চাকরী রক্ষার প্রতিশ্রুতিও দিল্লির তরফ থেকে দেয়া হয়েছিল। প্রণব মুখার্জী সেই সময় কংগ্রেস সরকারের খুবই প্রভাবশালী পররাষ্ট্র মন্ত্রি ছিলেন।

দেশদ্রোহী জেনারেল মইন ভারত থেকে কয়েকটি ঘোড়া উপহার নিয়ে বাংলাদেশে ফিরেই যে কোন মূল্যে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জেতানোর কলাকৌশল আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। তার সেই রাষ্ট্রবিরোধী অপকর্মে ড: শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন তৎকালিন নির্বাচন কমিশন সোৎসাহে মদদ দিয়েছিল। সেই নির্বাচন কমিশনে বাকী দুই কমিশনার ছিলেন আমলা ছহুল হোসেন এবং ব্রি:জে: (অব:)সাখাওয়াত। প্রয়াত ছহুল হোসেন পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন পাওয়ার চেষ্টা করে কেন জানিনা ব্যর্থ হয়েছিলেন। আর ভাগ্যবান ব্রি:জে: (অব:)সাখাওয়াত বিস্ময়করভাবে “আগস্ট বিপ্লব” পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন ড: ইউনুস সরকারের বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা। ভুলো মনের বাঙ্গালী মুসলমানের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার জন্য শামসুল হুদা কমিশনের কিছু কর্মকান্ডের উল্লেখ করছি:

১। কমিশন প্রথমেই বি এন পি ভাঙ্গার কৌশল গ্রহণ করেছিল। ডিজিএফআই এর অতি প্রভাবশালী আমিন-বারি জুটি মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে এক নতুন বিএনপি করার সর্বরকম প্রচেষ্টা নেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের সাথে নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু হলে শামসুল হুদা কমিশন বেগম খালেদা জিয়া মনোনিত বৈধ মহাসচিব মরহুম খন্দকার দেলোয়ারের পরিবর্তে ডিজিএফআই সৃষ্ট ভেজাল বিএনপির মহাসচিব মেজর(অব:) হাফিজকে সংলাপে অংশগ্রহণের আমন্ত্রন জানায়।

২। শামসুল হুদা কমিশন এমনভাবে সংসদীয় সীমানা নতুন করে নির্ধারন করে যাতে করে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ স্বরূপ, বিএনপি সমর্থক এলাকা বলে পরিচিত মানিকগঞ্জে সংসদীয় আসন সংখ্যা পূর্বের চার থেকে কমিয়ে তিনে নিয়ে আসে। ২০০১ সালের নির্বাচনে মানিকগঞ্জের চারটি আসনেই বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। এমন প্রক্রিয়া ৩০০ আসনেই চালানো হয়।

৩। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে জেনারেল মইন নির্বাচন কমিশনার ব্রি: জে: সাখাওয়াতের সাথে কক্সবাজারে এক গোপন বৈঠক করেন বলে সেই সময় প্রচারিত হয়েছিল। এমন কোন বৈঠক হয়েছিল কিনা এবং হয়ে থাকলে সেখানে কি আলোচনা হয়েছিল সেটি ড: ইউনুস সরকারের উপদেষ্টাই ভাল বলতে পারবেন। স্বচ্ছতার খাতিরে এ বিষয়ে তার মুখ খোলা উচিৎ।

৪। বিশ্ববাসী ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স নৌকার পক্ষে ভরে রাখার কাহিনী মোটামুটি জানে। সেই সময়কার জাপানী রাষ্ট্রদূত বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্য মন্তব্য করে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু, একই প্রকার অনিয়মের যে ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে একেবারেই আলোচনা হয় না তা হলো, নৌকার পক্ষে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কৌশল ড: শামসুল হুদা কমিশনই ২০০৮ সালের নির্বাচনে শিখিয়ে গেছে। কেমন করে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এক অসম্ভব ভূমিধ্বস বিজয় সম্ভব করানো হয়েছিল এবং পরিণামে বাংলাদেশে কি হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমি ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে পাঁচ কিস্তিতে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলাম (প্রধান নির্বাচন কমিশনার কী চমৎকার কথা রাখলেন-৪/১/২০০৯, পরিসংখ্যান কথা বলে-৭/১/২০০৯, কেন এই অসম্ভব ফলাফল?-১৪/১/২০০৯, কেন এই অসম্ভব ফলাফল?-২১/১/২০০৯, এবং পরবর্তী লড়াই-২৮/১/২০০৯)। উল্লিখিত লেখাগুলো আমার “১/১১ থেকে ডিজিটাল” বইতে পাওয়া যাবে। উৎসাহী পাঠক চাইলে পড়তে পারেন। ড: শামসুল হুদা এবং ব্রি: জে: (অব:) সাখাওয়াত এখন সুশীলের ভূমিকায় অবতীর্ন হলেও ফ্যাসিবাদ কায়েমে তাদের দায়মুক্তি ঘটার কোন সুযোগ নাই।

এতো গেল শামসুল হুদা কমিশনের কীর্তিকলাপ। এরপর এলো রকিব কমিশন। তারা ২০১৪ সালে আর এক রকম তেলেসমাতি দেখালো। নির্বাচনের আগেই ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কিনা আমার অন্তত: জানা নাই। অর্থাৎ, রকিব কমিশনের তেলেসমাতিতে নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছিল। বাকশালী কায়দায় শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয়বার সম্পূর্ণ বেআইনী প্রধানমন্ত্রী বনে গেলেন। জাতির সাথে কী বীভৎস তামাশা! আর কারা ছিল সেই রকিব কমিশনে তাদের তালিকাও নীচে দিলাম:

১। রকিবউদ্দিন আহমেদ-প্রধান নির্বাচন কমিশনার
২। মোহাম্মদ শাহনওয়াজ
৩। ব্রি: জে: (অব:) জাভেদ আলী
৪। মোহাম্মদ আবদুল হাফিজ
৫। মোহাম্মদ আবদুল মোবারক

তারপর ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশনের নৈশ ভোটের পালা। আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরার কেরামতি দেখে সারা বিশ্ব নির্বাক। সিসি-পুটিনরা কেন যে নুরুল হুদাকে বিশেষ সন্মান দিয়ে ইজিপ্ট কিংবা রাশিয়ার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিচ্ছে না ভেবে পাই না। ২০০৮ এবং ২০১৮ সালে দুই হুদা বাংলাদেশে দানব হাসিনার উত্থানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। নুরুল হুদার অন্যান্য সাঙ্গাৎদের ভুলে যাওয়া খুবই অন্যায় হবে। তারা হলেন:

১। শাহাদাত হোসেন চৌধুরী
২। কবিতা খানম
৩। রফিকুল ইসলাম
৪। মাহবুব তালুকদার***

মরহুম মাহবুব তালুকদার নামটির পাশে তিনটি তারা চিহ্ন দিয়েছি কারণ তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যে, একদল নির্লজ্জ ক্রিমিনালদের মাঝে অবস্থান করেও, অসীম সাহসের সাথে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মাহবুব তালুকদার আমার দেশ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। তিনি সফল না হলেও তার বীরোচিত সংগ্রামের কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তার উত্তম পুরষ্কারের জন্য বিনীতভাবে দোওয়া করছি।

সর্বশেষ ২০২৪ সালে বাকপটু আওয়াল কমিশন জাতিকে “ডামি নির্বাচন” দেখিয়েছে। সুশীলের মুখোশধারী ক্রিমিনাল হাবিবুল আওয়াল তার সুন্দর বাক্য দ্বারা মরহুম ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরিকেও বিভ্রান্ত করে ফেলেছিলেন। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী হাবিবুল আওয়ালের নিয়োগকে কি আশায় যেন স্বাগত: জানিয়েছিলেন। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় জাফর ভাইও ভুল করেছিলেন। ডামি নির্বাচনের অন্য কুশিলবরা হলেন:

১। মোহাম্মদ আলমগীর
২। আনিসুর রহমান
৩। আহসান হাবিব খান
৪। রাশিদা সুলতানা

২০০৮ সাল থেকে যে ১৮ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের মধ্যে একমাত্র মরহুম মাহবুব তালুকদার ছাড়া বাকী ১৭ জন শেখ হাসিনা নামক দানবের উত্থানে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই সময়কালের নির্বাচন কমিশনের সচিবরাও একই জাতের অপরাধী। আমি মনে করি বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ভারতের পদতলে অর্পণ করার প্রক্রিয়ায় সহযোগীরূপে এদের প্রত্যেকের বিচার হওয়া উচিৎ। বিপ্লবী ছাত্র-জনতার এদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ