জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থী-জনতার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসহ ১৫দফা দাবি জানিয়েছেন ‘লড়াকু ২৪’ নামে একটি সংগঠন।

সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এসব দাবি জানায় সংগঠনটি।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের গবেষক কানিজ ফারজানা মিথিলা বলেন, গত ১৫ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকারি বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী ও সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পেটোয়া সন্ত্রাসীদের হামলা শুরুর ২ মাস পূর্ণ হয়েছে। গত দুই মাস ধরে এ আন্দোলনে গুরুতর আহত অনেকে এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ইতোমধ্যে, অনেকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, হাত-পা হারিয়ে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আবার অনেকের মাথায় বা মেরুদণ্ডে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে চিরস্থায়ীভাবে প্যারালাইজড্ হয়েছেন এবং কেউ কেউ প্যারালাইজড্ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আন্দোলনে আহত-নিহতদের একটা অন্যতম অংশ শ্রমজীবী, খেটে-খাওয়া মানুষ। তাদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছেন এবং ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

যাদের রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদের যেন আমরা ভুলে না যাই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা সরকার এবং আমাদের সকলের নাগরিক কর্তব্য। একইসঙ্গে, স্বাস্থ্যখাতের সংস্কারের মাধ্যমে অব্যবস্থাপনা দূর করে মানুষের দুর্ভোগ, হয়রানির অবসান ঘটাতে হবে।

সংগঠনটির ১৫ দফা দাবিগুলো হলো-

১. জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সারাদেশের সকল আহত শিক্ষার্থী-জনতাকে চিহ্নিত করে অতি দ্রুত প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করতে হবে।

২. আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা বলতে কেবল তাদের শারীরিক ক্ষতকে বিবেচনা করলে চলবে না। বরং আহত প্রত্যেক ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক, মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আহত ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত স্বজনদের ব্যয়ভারও সরকারকেই বহন করতে হবে।

৩. আহত-নিহতের পরিবারের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে বেশি খারাপ এবং দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন দরকার তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে হবে। যাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে, তাদেরকে বিকল্প কর্মসংস্থান দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। যারা দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছেন কিংবা চিরস্থায়ীভাবে প্যারালাইজড্ হয়ে গেছেন- তাদের পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহতদের মধ্যে যাদের জরুরিভিত্তিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া জরুরি,

আর কালক্ষেপন না করে অবিলম্বে সরকারের উদ্যোগে বিদেশে নেওয়া ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা, এটি তাদের জীবনমরণের প্রশ্ন। ৫. আহতদের তথ্যসংগ্রহে প্রতিটি জেলাকেন্দ্রিক ‘জরুরি তথ্যসংগ্রহ কমিটি’ গঠন করতে হবে যারা সারাদেশ

থেকে তথ্য সংগ্রহ করবেন। এই কমিটির সদস্যতালিকায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সর্বজন গ্রহণযোগ্য বিশেষজ্ঞ, প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষার্থী ও সচেতন জনতার অংশগ্রহণ থাকতে হবে। কমিটির সদস্যদের তথ্যসংগ্রহের বিষয়ে সরকারি তহবিলের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

৬. প্রত্যেক আহত রোগীর পরিবারের সঙ্গে এক থেকে দুইজন শিক্ষার্থী বা নাগরিক স্বেচ্ছাসেবীদের যুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যারা একজন আহত ব্যক্তির দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা ও বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় পাশে থাকবেন।

৭. করোনাকালীন সময়ের মতো আহতদের সার্বিক চিকিৎসা পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রতি সপ্তাহে স্বাস্থ্যব্রিফ করতে হবে।

৮. আহতদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় এবং গ্রামে বাড়ি তাদের দ্রুত ছাড়পত্র দিয়ে কিছুদিন পরপর

চেকআপে আসতে না বলে বরং তাদের জন্য বিশেষায়িত আবাসিক চিকিৎসার তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. যে সমস্ত আহত ব্যক্তিরা বিভিন্ন এনজিও ঋণ নিয়েছেন- তা মওকুফ করতে হবে।

১০. আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

১১. দলীয় রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে চিকিৎসকদের পেশাগত নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে সেবা প্রদানে সচেষ্ট থাকতে হবে। চিকিৎসকদের পেশাগত নৈতিকতা নিশ্চিত করতে সরকারকে নিয়মিত তদারকি করতে হবে।

১২. সরকারের তত্ত্বাবধানে সকল সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগের স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রমগুলোর সমন্বিত ও জবাবদিহিতামূলক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। সকল ক্ষেত্রে অর্থায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

১৩. জরুরিভিত্তিতে প্রত্যেক জেলায় সরকারি হাসপাতালে আহতদের জন্য জরুরি তথ্য ও চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র খুলতে হবে।

১৪. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বুঝতে হবে আহতদের জন্য প্রতিটা মুহূর্ত জীবন মরণের সমান। তাই সরকারের পক্ষ থেকে হাসপাতালে রোগীদের আনুষ্ঠানিক দেখতে যাওয়া এবং দেখে বেরিয়ে এসে গণমাধ্যমের সামনে আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি দেয়ার সময় শেষ। আশ্বাস দিয়ে কালক্ষেপণের নীতি এই মুহূর্তে বর্জন করতে হবে। আহত শিক্ষার্থী-জনতার চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দীর্ঘসূত্রিতার অবসান ঘটিয়ে আর একদিনও কালক্ষেপন নাকরে সরকারের তৎপরতা দৃশ্যমান করতে হবে।

১৫. জাতীয় পর্যায়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যারা কেবল মাত্র আহতদের চিকিৎসায় পরামর্শ দেবেন ও নজরদারি রাখবেন। প্রয়োজনে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এমন বিদেশী বা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসকদের এই টাস্কফোর্স-এ নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। যেমন Doctors Without Borders-এর চিকিৎসকদের এই টাস্কফোর্স-এ অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা যেতে পারে।

সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী সুমিতা রবিদাসের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন নৃবিজ্ঞানী ও লেখক রেহনুমা আহমেদ, গবেষক ও সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখ।
এ ছাড়াও আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।