মাহমুদুর রহমান: ২০১০ সালের ২ জুনের সুবেহ সাদেকের কিছুটা আগে আমার দেশ অফিস থেকে শতাধিক পুলিশের বিশাল বাহিনী এসে আমাকে গ্রেফতার করে।

শেখ হাসিনার দানবীয় শাসনকালে দেশের জনগণ মোটামুটি চেনে এমন মানুষদের মধ্যে আমিই প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলাম।

আমার গ্রেফতারের কয়েক সপ্তাহ পরে জামাতের নেতাদের গ্রেফতার পর্ব শুরু হয়েছিল। আমার প্রথম রিমান্ডের অভিজ্ঞতা হয়েছিল কোতোয়ালী থানায়। “জেল থেকে জেলে” বইটিতে আমার রিমান্ড এবং প্রথম দফার জেলজীবনের দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। আজ সেগুলোর পুনরাবৃত্তির কোন ইচ্ছা নাই। কেবল কোতোয়ালী থানার প্রবল পরাক্রান্ত তৎকালিন ওসি’র পরিচয় দেয়া এবং অতি সংক্ষেপে আর দুই একটি ঘটনার কথা বলা জরুরী।

খুবই আলোচিত কোতোয়ালীর তখনকার ওসিকে আপনারা ওসি সালাহউদ্দিন নামেই চেনেন। এক রহস্যজনক জঙ্গী নাটকে ২০১৬ সালে নিহত হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে ওসি বলতে প্রধানত: ওই একজনকেই বোঝাতো। ক্রমেই নির্মমভাবে টর্চার, থানায় নিয়ে হাঁটুতে গুলি করে হাড় (Knee Cap) উড়িয়ে দিয়ে পঙ্গু করা এবং মানুষ খুন করা তার নেশায় পরিণত হয়েছিল। শুনেছি এনকাউন্টারে ভিক্টিমের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা না করলে তার তৃপ্তি হতো না।

যাই হোক, সন্ধ্যায় ঢাকা সি এম এম আদালত থেকে কোতোয়ালী থানায় নিয়ে আমাকে গারদে রাখা হলো। ঘন্টা দুয়েক পর দেখলাম দোর্দন্ড প্রতাপশালী ওসির আগমনে পুরো থানা সচকিত হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ পর থানার “জমিদারের” ঘরে আমার ডাক পড়লো।

ওসি সালাহ উদ্দিন আমার দিকে তাচ্ছিল্য এবং ঘৃণামিশ্রিত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলতে লাগলেন যে, বিএনপি সরকার কত খারাপ ছিল এবং “আপা” অর্থাৎ শেখ হাসিনা তার কতটা ঘনিষ্ঠ। তিনি এটাও জানাতে ভুললেন না যে, তার বাড়ি গোপালগঞ্জে “আপার” বাড়ির কাছেই। তাদের মধ্যে টেলিফোনে নাকি কথাও হয়। তার একটানা বক্তৃতা শেষ হলে আবার আমাকে পুঁতিগন্ধময় গারদে পাঠানো হলো।

বুঝতে পারলাম জনগণের টাকায় প্রতিপালিত পুলিশ শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাহিনীতে পরিণত হয়ে যেতে আর বিশেষ বাকী নেই। কোতোয়ালী থেকে আমাকে পরবর্তী রিমান্ডে ক্যান্টনমেন্ট থানায় পাঠানো হলো। সেখানে প্রথম রাতেই একটার দিকে পুরো থানার বাতি নিভিয়ে আমার সেলে চার-পাঁচজন খুনি টর্চার করার জন্য ঢুকলো। আমি দ্রুতই জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তারা হয়ত মৃত ভেবে ফেলে রেখে গেছিল। জ্ঞান ফিরে দেখলাম ডিউটি অফিসারের ঘরে পড়ে আছি। সর্বাঙ্গ ভেজা, হয়তো জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টায় পানি ঢেলেছিল। ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে গেলাম ডিবিতে।

সেখান থেকে র‍্যাব-১ এর আয়নাঘরে। টানা দিন দশেকের রিমান্ড শেষের আগের রাতে ঘরে ডেকে নিয়ে তৎকালিন ডিবি প্রধান আমাকে জানালো যে, আমাকে কতটা টর্চার করা হচ্ছে তার রিপোর্ট শেখ হাসিনা এবং সাহারা খাতুনকে নিয়মিত দিতে হয়েছে।

তেজগাঁও থানার রিমান্ডের সময় আমাকে জানানো হলো, এসি বিপ্লব সরকার নাকি আমার উপর খুবই ক্ষিপ্ত। এত জুনিয়র একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আমার তখন ব্যক্তিগতভাবে চেনার কোন কারণ ছিল না। পরে বুঝতে পারলাম বি এন পি’র চীফ হুইপ জয়নাল আবেদিন ফারুকের উপর প্রকাশ্যে বিপ্লব এবং হারুনের প্রায় প্রাণঘাতী আক্রমণের খবর সেই সময় আমার দেশ পত্রিকায় বিষদভাবে ছাপা হওয়ার ফলেই এসি বিপ্লব আমার ওপর বিশেষভাবে খাপ্পা ছিল।

পুলিশের ক্রমশ: দানব হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বোঝানোর জন্যই কয়েকটি প্রাসঙ্গিক ঘটনার উল্লেখ করলাম।

প্রায় ষোল বছরের দানবীয় শাসনকালে শেখ হাসিনা পুলিশকে ব্যবহার করে যে হাজার হাজার হত্যা, নির্যাতন করেছেন সেটি পাঠকরা মোটামুটি জানেন। বিরোধী দলের সব বয়োজৈষ্ঠ নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে যে অকথ্য দুর্ব্যবহার করা হয়েছে তার বর্ণনা করে আমি তাদের দ্বিতীয়বার সন্মানহানি করতে চাই না।

প্রায় পাঁচ বছরের জেলজীবনে তাদের কাছ থেকে সেই সব ঘটনা শুনে আমার অনেক বিনিদ্র রাত্রি কেটেছে। কাশিমপুর জেল থেকে প্রিজন ভ্যানে ঢাকায় সি এম এম আদালতে যাওয়ার পথে সঙ্গের পাহারাদার পুলিশের কনস্টেবলরা প্রায়ই অহংকার করে বলতো, “শেখ হাসিনাকে তো আমরাই ক্ষমতায় রেখেছি”।

একের পর এক গণহত্যা চালিয়েও বেনজির গংদের মধ্যে কোনরকম অনুশোচনা জাতি কখনও দেখে নাই। বরঞ্চ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হয়েও তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে মালিকসুলভ আচরণ করেছে। গণহত্যা চালিয়ে টেলিভিশনে এসে নিয়মিত বড়াই করেছে। শাপলা চত্বরের গণহত্যার কথা স্মরণ করে বিষন্ন বোধ করি। আগস্ট বিপ্লবে নিহত শহীদদের জাতি আজ সঙ্গত কারণেই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে।

অথচ, ২০১৩ সালের সেই মাদ্রাসার ছেলেগুলোকে আমরা একেবারেই ভুলে গেছি। তাদের নাম জানারও চেষ্টা করি নাই। এর একটা কারণ হলো শ্রেণিবিদ্বেষ। সেদিনের বিপ্লবীরা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিল। শহুরে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের গরীবের সন্তান নিয়ে কোন মাথাব্যথা নাই। উপরন্তু, সেদিনের শহীদদের এক বড় অংশই ছিল এতিম। কে আর তাদের কথা মনে করে চোখের পানি ফেলবে? তার ওপর তারা সবাই মাদ্রাসার পড়ুয়া ছিল।

৯০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর হতভাগ্য বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা তো আবার অমার্জনীয় অপরাধ! প্রথম আলো মার্কা সুশীল সেক্যুলারদের বিবেচনায় হাটহাজারি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা কূপমন্ডুকতা, কিন্তু ইসকনের স্কুলে কিংবা রামকৃষ্ণমিশনে পড়লে সেটা প্রগতিশীলতা।

ভারতের পরামর্শে এক দানব সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার অভিলাষে পুরো পুলিশ বাহিনীটিকে আওয়ামীকরণের মাধ্যমে স্যাডিস্ট করে তুলেছিল। এমন অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পুরো বাহিনীকে দোষারোপ করা সমীচিন হবে না।

তবে, বাঙ্গালী মুসলমানের স্মৃতিশক্তি বড়ই দুর্বল। দেখতে পাচ্ছি নির্মম ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনাকে পরাভূত করার আনন্দে ইতোমধ্যে তার সহযোগী অপরাধীদের ভুলে যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। তাই, ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছায় পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আমার জানা অনুসারে প্রধান খুনিদের নামগুলো লিখে গেলাম:
১। মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান (লোকটি সেনাবাহিনীর হলেও হত্যাকান্ড চালিয়েছে র‍্যাবে অন্তর্ভুক্তির পর থেকে)
২। বেনজির অহমেদ
৩। নুর মোহাম্মদ
৪। শহিদুল হক
৫। জাভেদ পাটোয়ারী
৬। আবদুল্লাহ আল মামুন
৭। মনিরুল ইসলাম
৮। আবদুল কাহার আখন্দ
৯। মো: শহিদুল্লাহ (এন এস আই)
১০। হারুন অর রশিদ
১১। বিপ্লব সরকার
১২। মেহেদি হাসান
১৩। প্রলয় কুমার জোয়ার্দার
১৪। কৃষ্ণপদ রায়
১৫। আসাদুজ্জামান মিয়া
১৬। হাবিবুর রহমান
১৭। শফিকুল ইসলাম
১৮। জয় দেব
আমি নিশ্চিত যে, উপরের ১৮ জন ছাড়াও আমার জানার বাইরে আওয়ামী পুলিশের মধ্যে আরো অনেক একই শ্রেণির দানব রয়েছে। সেই নামগুলো আমাদের পুলিশ বাহিনীর মধ্য থেকেই জানতে হবে। রাষ্ট্রের আইন আনুসারে দানব হাসিনার এই সকল খুনীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে আমরা যদি সক্ষম না হই তাহলে ছাত্র-জনতার মহান আগস্ট বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যাবে। আশা করি, বর্তমান শাসকরা ক্ষমতার মোহে কোন আপোষ করে অথবা দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে ষোল বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের হাজার হাজার শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ